শেখ মাহতাব হোসেন, ডুমুরিয়া (খুলনা)
খুলনার ডুমুরিয়া প্রকৃতির ঋতুবৈচিত্র্য অনেকটাই হারিয়ে গেছে। শরৎকালেও দেখা মিলছে বর্ষার আবহ। দীর্ঘায়িত বর্ষা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো ডুমুরিয়াও কয়েক দফা ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে উপজেলার অন্তত সাড়ে তিন হাজার পুকুর ও মাছের ঘের। মৎস্য ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। ভারী বৃষ্টিতে কৃষকদের ফসলি জমি, ক্ষেতের সবজিসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এ বিষয়ে ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোঃ ইনসাদ ইবনে আমিন বলেন, ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হয়েছে। তাদের মাঝে সরকারিভাবে বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ করা হবে। আশা করছি, সার ও বীজ বিনামূল্যে সরবরাহ করা গেলে কিছুটা হলেও তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। ডুমুরিয়া সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান রিগান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ঘের ব্যবসায়ীদের তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে মৎস্য ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করা হবে। বরাদ্দ না পেলে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার কোনো সুযোগ নেই। মৎস্য ব্যবসায়ীরা যাতে আগামীতে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন সে জন্য মাঠ পর্যায়ে তাদের বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন মাঠকর্মীরা। ডুমুরিয়া কৃষি ও মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ভারী বর্ষণে মৎস্য ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে অন্তত শত শত কোটি টাকা। আর কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে অন্তত কোটি টাকা। সবমিলিয়ে উপজেলায় কৃষি ও মৎস্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ অন্তত শত শত কোটি টাকা। ডুমুরিয়া উপজেলায় প্রায় ৬ লাখ মানুষের বসবাস। বিল ও ঘেরবেষ্টিত এ জনপদের মানুষের প্রধান জীবিকার উৎস কৃষিকাজ ও মৎস্য চাষ। এই জনপদের ৮২ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। ধান, পাট, গমসহ বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি এ জেলার অন্তত ৫০ হাজার মানুষ মৎস্য চাষের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। ডুমুরিয়া উপজেলা শহরের ঘের ব্যবসায়ী জানান, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত তিনি। শেখ আব্দুল করিম বিলের মধ্যে তিনটি ঘের রয়েছে তার। বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে এ বছরও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ শুরু করেছিলেন। কিন্তু টানা বৃষ্টিতে তার তিনটি ঘেরই তলিয়ে যায়। নষ্ট হয় ঘের পাড়ের বিভিন্ন সবজি। ইতিমধ্যে প্রান্তিক এই মৎস্য ব্যবসায়ী ৩ লাখ টাকা খরচ করেছেন। ভেবেছিলেন অন্তত ৫ লাখ টাকা লাভ হবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন নিমিষেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ধার দেনা করে মাছ ছাড়লেও সব মাছ বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে। স্থানীয় কৃষক ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানান, ডুমুরিয়া প্রতিটি বিল ও ঘের অঞ্চলের মৎস্য ব্যবসায়ী ও কৃষকদের একই অবস্থা। কয়েক দফা বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় বহু রাস্তাঘাট, ক্ষেতের ফসল, মাছের ঘের ও পুকুর। এতে চরম বিপাকে পড়েন উপজেলার হাজারো মৎস্য ব্যবসায়ী ও কৃষক। দীর্ঘায়িত বর্ষা মৌসুমে তিন দফা ভারী বর্ষণে উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিল শিংগা উপজেলার মৎস্য চাষি ও প্রান্তিক কৃষকরা। ঘেরের মাছ ভেসে যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন তারা। মৎস্য চাষী জামির শেখ বলেন, দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে ঘের ব্যবসা করি। বৃষ্টিতে এত ক্ষতি কখনো হয়নি। সাড়ে তিন একর জমিতে দুটি ঘেরে যত মাছ ছিল সব চলে গেছে। অন্তত ৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে আমার। একই এলাকার আরেক মৎস্য চাষী দিঘুল রাজবংশি বলেন, পাঁচটি ঘেরের মধ্যে চারটি ঘেরের মাছ চলে গেছে। ঘের পাড়ের সব সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। এতে ১০ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। কৃষক রমেশ চন্দ্র জানান, বিল আর ঘের চেনার উপায় নেই। সব পানিতে তলিয়ে গেছে। রানাই গ্রামের কৃষক আব্দুল গফুরের ভাষ্য মতে, যেসব জমিতে পায়ে হেঁটে যেতাম সেই জমিতে নৌকা ছাড়া যেতে পারছি না। জমিতে কোনো ফসল অবশিষ্ট নেই। সব নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষি বিভাগ ও মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে মোট ঘের রয়েছে ৫ হাজার ৩০৩টি। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে অন্তত সাড়ে তিন হাজার ঘের ও পুকুর। এ অঞ্চলের ৬৬ শতাংশ ঘের পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এ জনপদে ঘের ব্যবসায়ী আছেন সাড়ে ১০ হাজার। আর এই পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত ৩/৪ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। শুধু মৎস্য খাতেই ক্ষতি হয়েছে অন্তত শত শত কোটি টাকা। এ ছাড়া আমন ধান, ঘের পাড়ের শিম, কুমড়া, শসা, পেঁপেসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি তলিয়ে যাওয়ায় কৃষি খাতে ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে অতি বৃষ্টিতে এ জনপদে ক্ষতির পরিমাণ শত শত কোটি টাকা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডুমুরিয়া খাদ্য ও মৎস্য চাষে উদ্বৃত্ত একটি উপজেলা। এ উপজেলার প্রায় ৬ লাখ মানুষের জন্য মাছের চাহিদা রয়েছে ১২ হাজার টন। প্রতি বছর উৎপাদন হয় অন্তত ১৮ হাজার টন মাছ। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অন্তত ৭হাজার টন মাছ উদ্বৃত্ত থাকে এ উপজেলায়। আর প্রতি বছর চাহিদা মিটেয়ে অন্তত ১ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে এ জনপদে।