মোস্তাকিম আল রা্ব্বি সাকিব
পরিবেশ-জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার অবৈধ ইটভাটা। অধিকাংশ অবৈধ ইঁভাটাই ফসলি জমি নষ্ট করে তৈরি করা হয়েছে। আর তাতে পোড়ানো কাঠের কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ দ‚ষিত হওয়ার পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলায় গড়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা। এমনকি বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ঘনবসতি এলাকার পাশেই কৃষি জমিতে ওসব অবৈধ ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট স‚ত্রে এসব তথ্য জানা যায়।সংশ্লিষ্ট স‚ত্র মতে, আইন অনুযায়ী কৃষিজমিতে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) সম্প‚র্ণ নিষিদ্ধ। আইনে বলা আছে, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে, বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটার এবং ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়কের অন্তত আধা কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। আইন অমান্য করলে অনধিক দুই বছরের কারাদন্ড, অন্য‚ন ২০ লাখ টাকা অর্থদÐ কিংবা উভয় দÐের বিধান রয়েছে। কিন্তু আইন অমান্য করেই সারা দেশে ইটভাটা বাণিজ্য খেয়ালখুশিমতো চলছে। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওসব অবৈধ ইটভাটাকে কোনো ধরনের দন্ডের মুখোমুখি হতে হয় না। আবার কেউ যদি দÐিত হন, পরে কৌশলে আবারো নতুন করে একই স্থানে ইটভাটা গড়ে তোলা হয়। সরেজমিনে খোজ নিয়ে জানা গেছে ,যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অবৈধ ইট ভাটা। অনেকখানে কয়লার বদলে পুড়ানো হচ্ছে কাঠ। নষ্ট হচ্ছে আবাদি জমি, পরিবেশ হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক ভারসম্য। দেশে আইন থাকলেও প্রয়োগ না থাকায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই মনিরামপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের আবাদি জমি থেকে মাটি ব্যবসায়িরা ট্রলি করে পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে হাজার হাজার মাটির গাড়ি নিয়ে ভাটায় মাটি বিক্রী করছে। ফলে রাস্তার ওপর মাটি পড়ে সড়ক দুর্ঘটনাও ঘটছে। অধিকাংশ ইটভাটায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও বৈধ কাগজপত্র নেই। তাছাড়া নিয়ম মেনে তৈরী করা হয়নি কোন ইটভাটা কিন্তু ইটভাটার অসাধু মালিকগন বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে তাদের ইটভাটার কাজ চলমান রেখেছে। পরিবেশে সবুজের পরিমান বাড়াতে ও কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান কমাতে বৃক্ষরোপনের আওতায় আনা হয়েছে গোটা দেশকে কিন্তু এ যেন শ্রোতের মুখে বালির বাধ! প্রাপ্ত তথ্যমতে মনিরামপুর উপজেলার বেশিরভাগ ইটভাটারই পরিবেশ অধিদপ্তরের বৈধ কাগজপত্র নেই। প্রভাবশালীরা বিভিন্ন ক্ষমতার জের ধরে এসব ইট ভাটা চালিয়ে যাচ্ছে। গড়ে তুলেছে ইটভাটা মালিক সমিতি। এমনিতে ভাটার চিমনি তৈরীতে সরকারি নির্দেশনা থাকলেও ইটভাটা মালিকরা ১২০ ফুটের পরিবর্তে ৬০/৮০ ফুট চিমনি ব্যবহার করছে। সরকারী নির্দেশ ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৮৯ ও ২০০১ সালের ১৭ নং অনুচ্ছেদের ৪ ও ৫ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, আবাদি জমিতে কোন ইটভাটা তৈরী করা যাবে না। ১২০ ফুট উঁচু চিমনি ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও ইটভাটা আইন-২০১৩ এবং সংশোধনী ২০১৯ এর ৮ ধারায় কতিপয় স্থানে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ করা ও নিয়ন্ত্রণ আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর, সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভ‚মি, কৃষি জমিসহ প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় ইট ভাটা স্থাপন করতে পারবে না। ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির পর থেকে অতীতে ও অন্য আইনে যাই থাকুক বিশেষ স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক গবেষণাগার প্রভৃতি এলাকা থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দ‚রে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে। নতুবা তা অবৈধ হবে। তাছাড়া জনবসতি এলাকা কৃষি জমিতেও ভাটা স্থাপন করা যাবে না। সরকারি সকল নির্দেশনা উপেক্ষা করে এসব ইটভাটা রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। স্কুল, কলেজ, বাজারের পাশে অথবা আবাদি জমির ওপর গড়ে ওঠা এসকল ইটভাটা থেকে নির্গত কালো ধোয়ায় নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। স্কুল কলেজ বা বাজারের পাশে ভাটা তৈরীতে ছাত্র ছাত্রী অথবা সাধারণ মানুষদের শ্বাসকষ্ট, হাপানি, ক্যন্সার সহ নানা রোগে ভুগতে হচ্ছে। এছাড়াও প্রতিদিন রাস্তার উপর দিয়ে মাটির গাড়ি চলার কারণে রাস্তার উপর মাটি পড়ে নষ্ট হয়েছে রাস্তাঘাট। হালকা বৃষ্টিতে যেকোন সময়ে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা!এ বিষয়ে মনিরামপুর ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি হাজী বাবর আলীর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান বৈধ কাগজপত্র বিহীন মনিরামপুর উপজেলায় মোট ৩১টা ইট ভাটা চালু আছে।তার দাবি পরিবেশ অধিদপ্তর নতুন করে সনদ নবায়ন করছে না। সর্বশেষ পরিবেশ অধিদপ্তরের আইন অনুযায়ী ইটভাটাগুলো পরিচালিত হচ্ছে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন সর্বশেষ আইন করার পর আর কোন নতুন ভাটা মনিরামপুরে তৈরী হয়নি এবং চলমান সকল ভাটাগুলো সংশোধনী আইনের প‚র্বে তৈরী করা। স‚ত্র জানায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র কিংবা জেলা প্রশাসকদের অনুমোদন ছাড়াই সারা দেশে প্রায় পাঁচ হাজার অবৈধ ইটভাটা গড়ে উঠেছে। ওসব ইটভাটার পাশে বসবাসকারীদের অভিযোগ, বছরের পর বছর ওসব অবৈধ ইটভাটা পরিচালিত হলেও বন্ধ করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। উল্টো প্রশাসনকে ঘুষ দিয়েই ইটভাটার মালিকরা এসব ভাটা পরিচালনা করছে। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে সারা দেশের অবৈধ ইটভাটার তথ্য চেয়েছে মন্ত্রণালয়। সেখানকার সর্বশেষ তথ্যে বলা হয়ছে, সারা দেশে চার হাজার ৮৩৬টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৭৩৩টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮০১টি, খুলনা বিভাগে ৯৮১টি, রাজশাহী বিভাগে ৮২৪টি, রংপুর বিভাগে ৭৭৮টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৯২টি, বরিশাল বিভাগে ২০৪টি এবং সিলেট বিভাগে ২৩টি। তবে অন্তর্র্বতী সরকারের পক্ষ থেকে এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া শুরু হয়েছে।এদিকে ইটভাটা মালিকরা জানান, প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে বছরে তাদের প্রত্যেককে ৪ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষের পেছনে খরচ করতে হয়। যার ইটভাটা যতো বড়, তার ঘুষের অঙ্কও ততো বেশি। এর বাইরে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্পন্সর করতে হয়। ওসব অনুষ্ঠানের আগে অবৈধ ইটভাটা মালিকদের কাছে টাকা চাওয়া হয়। তবে মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালিত হলেও আগে থেকে তাদের জানিয়ে দেয়া হয়। ম‚লত উপজেলা ও জেলা অফিসে একটি সিন্ডিকেট আছে। তাদের মাধ্যমেই বিষয়টি ম্যানেজ করা হয়। কখনো উপজেলা অফিসের কর্মকর্তাদের আত্মীয়-স্বজনকে কম দামে ইট দেয়া হয়, আবার কখনো বিনা ম‚ল্যে। প্রতিটি জেলায় ইটভাটা মালিকদের সমিতি আছে। ওসব সমিতির মাধ্যমে প্রশাসনকে ম্যানেজ করা হয়।অন্যদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনে (বিবিএমওএ) নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়সভা করেছেন। সভায় উপদেষ্টা জানান, ইটভাটাজনিত বায়ুদ‚ষণ রোধে নতুন করে আর ইটভাটার ছাড়পত্র দেয়া হবে না। যেসব ইটভাটা পরিবেশ নষ্ট করছে সেগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করা হবে। পার্বত্য এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলো স্থানান্তরের কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। মনিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রশাসক নিশাত তামান্না জানান, দোষীদের বিরেুদ্ধ মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অবশ্যাই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মাদ আব্দুল মোতালিব জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর সব সময় কঠোর অবস্থানে রয়েছে। অবৈধ ইটভাটার ব্যাপারে অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হয়। একই বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক জানান, সারা দেশ থেকে অবৈধ ইটভাটার তালিকা সংগ্রহ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। গুরুত্ব বিবেচনায় ওসব ইটভাটা উচ্ছেদের কাজ শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে সব ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয়া হবে। ওই লক্ষ্যে কাজ চলছে।