কণ্ঠ ডেস্ক
যশোরে ঝরে পড়া শিশুদের নিয়ে চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) ছয় শতাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তারা গত সাত মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড় না হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি জেলার ৫৬৬টি শিখন কেন্দ্র চালু রাখতেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থাকেও হিমসিম খেতে হচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্টরা দ্রুত অর্থ ছাড় করার জন্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে শতভাগ শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। (পিইডিপি-৪) এর মূল লক্ষ্য প্রাক প্রাথমিক হতে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত সকল বিদ্যালয়গামী শিশুর একীভূত, সমতাভিত্তিক মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা।এরই সাব কম্পোনেন্ট ২.৫ এর আউট-অব-স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন প্রোগ্রাম। যার মূল লক্ষ্য প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে বিদ্যালয় বহির্ভূত (ঝরে পড়া এবং ভর্তি না হওয়া) ৮-১৪ বছর বয়সী শিশুদেরকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়া এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মূল ধারায় নিয়ে আসা। যশোর জেলায় এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব গ্রহণ করে দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা।দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র কর্মকর্তারা জানান, যশোরের ৮টি উপজেলায় এবং যশোর পৌরসভায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০২১ সালে জেলার ৫৬৬টি শিখনকেন্দ্রে ১৬ হাজার ৯৮৫জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে ৩ হাজার ৮৯৪ জন শিক্ষার্থীকে মূল ধারায় সংযুক্ত করা হয়েছে এবং বর্তমানে ১৩ হাজার ৯১ জন শিক্ষার্থী ৫ম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে। প্রকল্পে বর্তমানে ৫৬৬ জন শিক্ষক, ৪২ জন সুপারভাইজার, ১০জন উপজেলা ম্যানেজার ও ১৮জন কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সর্বমোট ৬৩৬ জন কর্মরত রয়েছেন।দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার বাস্তবায়নকৃত আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন কর্মসূচিতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো শিক্ষকদের বেতন, শিখন কেন্দ্রের জন্য ঘর ভাড়া, সুপারভাইজার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বরাদ্দ সরাসরি ব্যুরো দিয়ে থাকে।প্রকল্পের যশোর পৌরসভা এলাকার ম্যানেজার শাহাফুর বখতিয়ার জানান, এই পৌরসভায় আমাদের ৬১টি শিখন কেন্দ্র চালু রয়েছে। কেন্দ্রগুলোর শিক্ষক বা সুপারভাইজারগণ একাউন্টপেয়ি চেকের মাধ্যমে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেতন পেয়েছেন। এরপর আর কোনো অর্থ ছাড় হয়নি। ফলে সংস্থা থেকে শিখন কেন্দ্রের ঘরভাড়াসহ আনুসাঙ্গিক ব্যয় মেটানো হলেও শিক্ষক-কর্মকর্তারা বেতন পাচ্ছেন না।যশোর পৌরসভার শিখন কেন্দ্রের শিক্ষক খালেদা আক্তার জানান, দীর্ঘ ৭মাস বেতন না পাওয়ায়অমানবিক অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। আত্মীয় স্বজনরাও আর টাকা ধার দিচ্ছে না; দোকানীরা টাকার জন্য ধর্ণা দিচ্ছে। খুব কষ্টে সংসার চালাতে হচ্ছে।যশোর পৌরসভা এলাকার প্রোগ্রাম সুপারভাইজার জেসিয়া নাসরিন বলেন, এই চাকরিই আমার একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু গত ৭মাস বেতন না পাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছি।তবে দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা শিখন কেন্দ্রসমূহে শিক্ষার্থীদের সরকারের দেয়া বিনামূল্যে বই, খাতা, স্কুল ব্যাগ, ড্রেস ইত্যাদি সরবরাহ করে পাঠদান অব্যাহত রেখেছে বলে জানিয়েছে।প্রকল্পের যশোর পৌরসভা এলাকার ম্যানেজার শাহাফুর বখতিয়ার আরও জানান, শিখন কেন্দ্রগুলি সরকারের সরবরাহকৃত সকল শিক্ষা উপকরণ দিয়ে যথাযথভাবে চলমান রয়েছে’ বলে সকল উপজেলা নির্বাহী অফিসার আইভিএ (স¦তন্ত্র যাচাই কমিটি) রিপোর্ট প্রদান করেছেন।যশোর পৌরসভার মোল্লাপাড়া বাঁশতলা শিখনকেন্দ্রের শিক্ষার্থী রাতুল শেখ জানায়, আমরা আগে প্রতি মাসে খাতা পেতাম, এখন দুই মাসে একবার খাতা পাচ্ছি। এতে আমাদের একটু সমস্যা হচ্ছে।আরেক শিক্ষার্থী রাফিয়া জানায়, আমরা বছরে একবার ড্রইং খাতা ও রং পেন্সিল পাই, ফলে ইচ্ছে মত ছবি আঁকতে পারি না। প্রতি বছর অন্তত ২বার ড্রইং খাতা ও রং পেন্সিল পেলে আমরা ইচ্ছে মত ছবি আঁকতে পারতাম। আরেক শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান জানায়, কেন্দ্রে অনেকেই উপবৃত্তির টাকা পেলেও আমি উপবৃত্তির টাকা পাইনি।এ বিষয়ে জেলা প্রোগ্রাম ম্যানেজার কামরুল ইসলাম বলেন, শুধু সদর উপজেলা নয়, যশোর পৌরসভাসহ জেলার ৮টি উপজেলার এক হাজার ২৯২জন উপবৃত্তি না পাওয়া শিক্ষার্থীর তালিকা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা শিক্ষা ব্যুরোতে প্রেরণ করা হয়েছে এবং সরকারিভাবে তালিকা সংশোধন করা হচ্ছে।যশোর জেলায় প্রকল্পটির বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত লিড অর্গানাইজেশন দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রাহিমা সুলতানা জানান, সরকারি বরাদ্দের অর্থ ছাড়ে দীর্ঘসূত্রিতা থাকলে দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা প্রকল্প নীতিমালা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করে চলেছে। শিখন কেন্দ্রের সকল শিক্ষা উপকরণ থেকে শুরু করে নিজ খরচে ছাত্রছাত্রীদের গ্রেড পরিবর্তনের পরীক্ষা গ্রহণ করে মূল ধারায় ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাই সুচারু রূপে কার্যক্রমটি সম্পন্নের জন্য দ্রুত অর্থ ছাড় হওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে যশোর জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র সহকারী পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাস বলেন, বাস্তবায়ন নির্দেশিকা অনুযায়ী যশোর জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সকল উপজেলায় আইভিএ (স¦তন্ত্র যাচাই কমিটি) রিপোর্ট অনুযায়ী কেন্দ্র চলমান রয়েছে। তবে ডিসেম্বর’২৩ এর পরে আর কোনো অর্থ ছাড় হয়নি। প্রকল্পের সফল সমাপ্তি ও সকল শিক্ষার্থীকে মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে প্রকল্পটি ৩০জুন-২০২৫ পর্যন্ত চলমান রাখা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।