বেনাপোল প্রতিনিধিঃ দেশের বৃহত্তর স্থলবন্দর যশোরের বেনাপোল কাস্টমস হাউজ গেলো ২০১৯-২০ র্অথবছরে লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ৩ হাজার ৩৯২ কোটি ২২ লাখ টাকা। তবে অর্থবছরের শুরুতেই রাজস্ব আয়ে পিছিয়ে ছিল এ কাস্টমস হাউজ। এরপর করোনায় এ পথে ভারতের সাথে টানা আড়াই মাস আমদানী বন্ধ থাকায় রাজস্ব আহরণ নেমে আসে আরো ধস।
শনিবার(১২ জুলাই) লক্ষ্য মাত্রার পরিসংখ্যনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা গোলাম সরোয়ার।
কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, গেল ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের উপর ৬ হাজার ২৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় । এসময় অর্থবছর শেষে (জুলাই থেকে জুন) লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ্য রাজস্ব আদায় করেছে মাত্র ২ হাজার ৬৩৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এখানে লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ৩ হাজার ৩৯২ কোটি ২২ লাখ টাকা। এসময় ভারত থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৬২৮মেঃটন।
এর আগেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেনাপোল কাস্টমস হাউজে ৫ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছিল ৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা। তখনও ঘাটতি ছিল ১ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। এ অর্থবছর ভারত থেকে আমদানি পণ্যের পরিমান ছিল ১৮ লাখ ৩৬ হাজার ৯৫৩ মে:টন। এছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি ছিল ১৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এসময় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। আদায় হয়েছিল ৪ হাজার ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক লতা জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়াতে এ বন্দর দিয়ে সবাই ব্যবসা করতে চাই। কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়ন সমস্যায় সুষ্ঠ বাণিজ্য বাধাগ্রস্থ্য হচ্ছে। সপ্তাহে ৭ দিন বাণিজ্য সেবা চালু থাকলেও ব্যবসায়ীরা তার সুফল পাচ্ছেনা। বাণিজ্য প্রসার করতে হলে বৈধ সুবিধা প্রদান ও অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছেন, শুল্কফাঁকি রোধে কড়াকড়ি আরোপ করায় আমদানী কমে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের বৈধ সুবিধাগুলো বাড়াতে কর্তৃপক্ষ্য আন্তরিক হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
বেনাপোল বন্দর ব্যবহার কারি সাধারণ ব্যবসায়িরা জানান, কাস্টমসে আমদানী পণ্য পরীক্ষনের নামে হয়রানি বেড়েছে। টাকা না দিলে নমুনা ঢাকায় ল্যাবরোটরিতে পাঠাতে চায় নায় না । পণ্য পরীক্ষনের ভাল ব্যবস্থা আর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজর থাকলে হয়রানি পোহাতে হতোনা। ঝামেলা এড়াতে এপথে আমদানি কমিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া অসৎ ব্যবসায়ীরা এপথে ভায়াগ্রার মত মাদক আমদানিও করছেন।
তারা আরো জানান, আমদানী পণ্য কাস্টমস কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সুনিদিষ্ট কোন অভিযোগ ছাড়া আবার বিজিবি সদস্যরা তা আটক করেছে। সেখানে ২/৩ দিন পন্য চালান আটকে থাকছে। আমদানী,রফতানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রন নিয়ে বিজিবি আর কাস্টমসের মধ্যে পরস্পরের সমন্বয় দরকার। এসব কারনেও বাণিজ্যে আগ্রহ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
বাণিজ্যের সাথে সংশিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বলছেন, বন্দর ও কাস্টমসের বিভিন্ন অনিয়ম,অব্যবস্থাপনা, শুল্কফাঁকি ও পণ্য খালাসে হয়রানি রাজস্ব ঘাটতির কারণ। এছাড়া বাণিজ্য তদারকিতে নিয়োজিত সংস্থ্যাগুলোর মধ্যে পরস্পরের সমন্বয়ের অভাব। এতে ব্যবসায়ীরা এ পথে বাণিজ্যে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় সরকারের যেমন রাজস্ব আয়ে বাধা গ্রস্থ্য হয়েছে তেমনি লোকশান গুনেছেন ব্যবসায়ীরাও। বৈধ সুবিধা নিশ্চিত হলে আবার গতি ফিরবে বাণিজ্যে।
জানা যায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় এপথে ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি। দেশে স্থলপথে যে পণ্য আমদানি হয় তার ৭০ শতাংশ হয় বেনাপোল বন্দর দিয়ে। এছাড়া প্রতিবছর এ বন্দর দিয়ে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার পন্য আমদানী হয়ে থাকে। যা থেকে সরকারের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। বন্দরে আমদানী পণ্যের ধারণ ক্ষমতা ৫০ হাজার মেঃটন কিন্তু এখানে সার্বক্ষনিক পণ্য থাকে প্রায় দেড় লাখ মেঃটন। বর্তমানে বন্দরে ২৮টি পণ্যগার, ৮টি ওপেন ইয়ার্ড,একটি ভারতীয় ট্রাক টার্মিনাল,একটি রফতানি ট্রাক টার্মিনাল ১টি ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড ও একটি ভারতীয় ট্রাক চ্যাচিজ টার্মিনালের মাধ্যমে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। তবে এসব উন্নয়ন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।আমদানী রফতানি ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি আজিজুল হক বলেন, বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন সমস্যা আর অনিয়মে বার বার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। এতে পুজি হারিয়ে পথে বসেছে অনেক ব্যবসায়ীরা। এখনও সাধারণ পণ্যগারে কেমিক্যাল পণ্য খালাস করা হয়। বহিরাগতরা অবাধে প্রবেশ করে বন্দরে। ব্যবসায়ীদের দির্ঘদিনের দাবী ছিল বন্দরের নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা স্থাপনের। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। এখন এ বন্দর দিয়ে ব্যবসায়ীরা আমদানী করতে ভয় পায়।
বেনাপোল বন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার বলেন, করোনার কারণে প্রথমত আড়াই মাস ধরে আমদানী বন্ধ ছিল। এ কারণে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। আর ইতোমধ্যে বেনাপোল বন্দরে অনেক অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। এ ছাড়া আরো যে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে এর মধ্যে বন্দরে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, জেলখানার মতো বন্দরের চারিদিকে প্রাচীর নির্মাণ ও নতুন জায়গা অধিগ্রহণ। এসব উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত হলে বেনাপোল বিশ্বের কাছে একটি আধুনিক বন্দর হিসেবে পরিচিতি পাবে, তখন আমদানী বৃদ্ধির পাশাপাশি দ্বিগুন রাজস্ব রাড়বে।
বেনাপোল কাস্টমস হাউজের যুগ্ম কমিশনার শহিদুল ইসলাম জানান, করোনার কারণে প্রথমত আড়াই মাস ধরে আমদানী বন্ধ ছিল। এ কারণে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। এছাড়া পণ্য চালান খালাসে পূূর্বের চেয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা বেড়েছে এ কাস্টমসে। শুল্কফাঁকি বন্ধে কড়াকড়ি আরোপ করায় কিছু ব্যবসায়ী এ বন্দর দিয়ে আমদানী কমিয়েছেন। বিশেষ করে রাজস্ব বেশি আসে এমন পন্য চালান কম আমদানি হচ্ছে। এতে রাজস্ব ঘাটতি হচ্ছে।