জহুরুল ইসলাম
শারদীয় দুর্গাপূজার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। প্রতীমা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ভাস্কর শিল্পীরা। এবছর যশোর জেলায় ৬৫২টি মন্দির ও মন্ডপে পূজার আয়োজন চলছে। গত বছরের তুলনায় জেলায় এবার ৮০টি স্থানে পূজা হচ্ছে না। জলাবদ্ধতা, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নিরাপত্তার অভাব ও আর্থিক সংকটের কারণে পূজা মন্ডপ কমেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যশোরের চৌগাছা উপজেলার বল্লভপুর গ্রামের ২৫টির মত হিন্দু পরিবারের বসবাস। তাদের উদ্যোগে দুর্গা মন্দিরে বর্ণিল আয়োজনের দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। কিন্তু এবছর সেখানে নেই উৎসব আয়োজন। হচ্ছে অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কেন এ বছর পূজা হচ্ছে না জানতে চাইলে বল্লভপুর গ্রামের বাসিন্দা ও বল্লভপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক তারক কুমার বিশ্বাস বলেন, আমরা সরকারের কাছ থেকে বাওড় লিজ নিয়ে চাষ করি। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা বাঁওড়ের প্রায় ৫০-৬০ লাখ টাকার মাছ লুট করে নিয়েছে। এতে আমাদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। নিজেদের চাঁদার টাকায় পূজা করি। এবার কারো চাঁদা দেয়ার সক্ষমতা নেই। এছাড়াও বাঁওড় দখলে নিতে সন্ত্রাসীরা প্রতিনিয়ত প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে।
এ বিষয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আর্থিক সংকট ও নিরাপত্তার অভাবে আমরা এবার পূজার আয়োজন করতে পারিনি।এদিকে, চৌগাছার খড়িঞ্চা বাওড়টি তিন গ্রামের মৎস্যজীবীদের রুটি-রুজির প্রধান উৎস। সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে খড়িঞ্চা, জলকর মাধবপুর ও দেবালয় গ্রামের কয়েক শত মৎস্যজীবী চাষাবাদ করেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর খড়িঞ্চা বাওড়ের প্রায় ২ কোটি টাকার মাছ লুট হয়েছে। পথে বসেছেন খড়িঞ্চা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্যরা। এবছর আর্থিক সংকটে তিন গ্রামে ৫টি মণ্ডপের একটিতেও এবার পূজার আয়োজন হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন খড়িঞ্চা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি ভরত কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, রুটি-রুজি লুট হওয়ায় আমরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। পূজা না হওয়ার অন্যতম কারণ আর্থিক সংকট।’ শুধু চৌগাছার বল্লভপুর কিংবা খড়িঞ্চা নয় যশোর জেলার ৮ উপজেলায় এবার শারদীয় দুর্গাপূজার মন্ডপ কমেছে ৮০টি। এত সংখ্যক মন্দির ও মন্ডপে পূজা না হওয়ার কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় সামনে এসেছে। আর্থিক সংকট, নিরাপত্তার অভাব ও জলাবদ্ধতা।জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্যমতে, এবছর যশোর জেলায় ৬৫২টি মন্দির ও মন্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজার প্রস্তুতি চলছে। গতবছর জেলায় ৭৩২টি পূজা হয়েছিল। যা গত বছরের তুলনায় ৮০টি কম। এরমধ্যে সদর উপজেলার ১০টি, কেশবপুর উপজেলায় ৬টি, মনিরামপুরে ৬টি, চৌগাছায় ১৩টি, ঝিকরগাছায় ৮টি, বাঘারপাড়ায় ১৪টি, শার্শায় ৪টি ও ও অভয়নগরে ১৯টি মন্ডপে পূজার আয়োজন কমেছে।যশোর শহরের বেজপাড়া মন্দিরে প্রতিমা তৈরির কারিগর জয়দেব পাল প্রতিদিনের কণ্ঠকে বলেন, এবছর শহর ছাড়া গ্রামে প্রতিমার কাজ কম হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত ৩৫ সেট প্রতিমার অর্ডার পেয়েছি। প্রতিমা তৈরির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব ধরণের কাজ করা লাগে। এখনও প্রতিমার চাহিদা রয়েছে। ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় এক একটি সেট প্রতিমা বিক্রি করি। এ বছর বেড়েছে নিরাপত্তার অভাব। জীবনে যা না, তাই এ বছর করতে হয়েছে। মাসিক ৮ হাজার টাকা বেতন দিয়ে প্রতিমা পাহারা দেয়ার জন্য লোক রাখতে হয়েছে।যশোর শহরের নীলগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা শ্যামল কুমার ঘোষ প্রতিদিনের কণ্ঠকে বলেন, এবছর দুর্গা উৎসবে আনন্দের চেয়ে অতঙ্ক বেশি। চারিদিকে অস্থিরতা। হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করছে, মারধর করছে। ভয়ে অনেকে দুর্গা উৎসবের আয়োজন করতে চাচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমা ভাংচুর করা হচ্ছে। উৎসবের আনন্দ শেষ কি হবে জানি না। অনিশ্চয়তায় দিন পার হচ্ছে।কেশবপুর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দুলাল সাহা প্রতিদিনের কণ্ঠকে বলেন, এবার কেশবপুরে ৯২ টা মন্ডপে পূজা হচ্ছে। যা গত বছরের চেয়ে ৬টি কম। এবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ ও জলবদ্ধতার কারণে পূজার সংখ্যা কমেছে।
যশোর জেলার পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি দীপংকর দাস রতন প্রতিদিনের কণ্ঠকে বলেন, গত বছরের তুলনায় পূজার মন্ডপ কমেছে। কেশবপুর, মনিরামপুরে জলাবদ্ধতার ভিতরে পূজার আয়োজন অনেক মন্দিরে করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া দেশে বড় একটা প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। তবে যশোরের কোথাও প্রতিমা ভাংচুর, হুমকি ধামকির কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। প্রত্যেক মন্ডপ এলাকায় হিন্দু মুসলিম মিলে নিরাপত্তা কমিটি করা হয়েছে। সরকারিভাবে মন্দিরে পূজার জন্য সহযোগিতা করা হচ্ছে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নেতারা যথেষ্ট সহযোগিতা করছে। তারপরও হিন্দু ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে মানুষের মনে কিছুটা অতঙ্ক রয়েছে।