বাগেরহাট সংবাদদাতা
বাগেরহাট সদর উপজেলার হোজি নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার। এর বিভিন্ন অংশ আটকে এত দিন ধরে মাছ চাষ করে আসছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্টরা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে গেছেন তারা। এর পর নদীটির দখল নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। শুধু নদী নয়, এত দিন জেলায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর দখলে থাকা বিভিন্ন খাল, মৎস্য ঘেরের পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন ঘেরও একে একে দখলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিএনপি-সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। মাছ লুটের পাশাপাশি অনেক ঘেরের মালিকের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগও আসছে। বিএনপির কেন্দ্র থেকে নেতাকর্মীকে দখল, নৈরাজ্য, লুটপাট থেকে বিরত থাকতে কঠোর নির্দেশনা দিলেও বাগেরহাটে তা খুব একটা কাজে আসছে না।হোজি নদী তীরবর্তী অঞ্চলে সরেজমিন জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী সমন্বিতভাবে নদীটি দখলে নেন। এতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত, আশপাশের কৃষিকাজ ও মাছ চাষের ক্ষতি এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলেও ডেমা ইউনিয়নের অংশ দখল করে মাছ চাষ করে আসছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পদধারী ২০-২৫ জন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই নদীর এসব অংশ দখলে নেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। তাদের মধ্যে ডেমা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আজাদ হাওলাদার, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক রসুল শেখ, বিএনপি কর্মী নাহিদ ফকির, শামিম ফকির, পান্না হাওলাদার, বাবুল শেখ, আনিস শেখ, রাসের ফকিরের নাম জানা গেছে। এ ছাড়া আরও কিছু ব্যক্তি মিলে পুরো নদীর দখল নিয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপি নেতা রসুল শেখের দাবি, তাদের দলের কোনো লোক দখলে জড়িত নয়। সেখানে একজনের ঘের দখল করে রাখা হয়েছিল, তারা সেটি উদ্ধার করে দিয়েছেন। আর হোজি নদী তাঁর ওয়ার্ডে নয়, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। তাঁর এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা ঠিক আছে।ডেমার ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আজাদ হাওলাদার অবশ্য নদীর দখলে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘এটা তো বড় নদী। গোড়ার দিকে হেদায়েতপুরে যারা বিএনপি করে তারা বেড় দিছে (ঘিরে দখল নেওয়া)। আর কাশেপুরের যারা বিএনপি করে তারা আগার দিকে বেড় দিছে। এমনি মাছ ধরাটরা হয় নাই। … এই নদীর মাঝে রাস্তার জন্য একটা ব্রিজ করতিছে। তাই বাঁধ দেওয়া আছে। ওরা (হেদায়েতপুর) এট্টু নিছে আর আগাটা আমাগো আয়ত্তে আছে। তবে এলাকায় কোনো দখল নাই।’এদিকে জেলায় এরই মধ্যে হাজারের বেশি ব্যক্তিমালিকানাধীন ও হারি (ভাড়া) দিয়ে করা মৎস্য ঘের লুট, দখল অথবা মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ৯ উপজেলার মধ্যে এমন অভিযোগ সবচেয়ে বেশি বাগেরহাট সদর, মোরেলগঞ্জ, রামপাল ও মোংলা উপজেলায়। সরকারি নদী-খালের পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন ঘেরও রক্ষা পাচ্ছে না। সদর উপজেলার ডেমা, বিষ্ণুপুর ও গোটাপাড়া ইউনিয়নে এমন ঘটনা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া গোটাপাড়া এলাকায় তালিকা করে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে বিএনপির নামধারীদের বিরুদ্ধে। নেতারা এতে সায়ও দিচ্ছেন। সম্প্রতি গোটাপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান (বিএনপি) বাসারাত হাওলাদারের একটি পথসভার বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। মুক্ষাইট মোড়ে ওই পথসভায় তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি নেতাদের অনুরোধ রাখব, কোনোভাবে আওয়ামী লীগের লোক যেন বাজারে উঠতি না পারে। বাড়িও না থাকতি পারে। আমাদের যেমন মারিছে, তাদের সেরকম ব্যবস্থা ইনশাআল্লাহ করবেন। আমি আপনাদের সঙ্গে আছি।’
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িতদের ঘের দখল করে নেওয়ার পর এখন অনেকে চাঁদা দিয়ে সমঝোতা করে চলছেন। নতুন করে ঝামেলা বা বিপদের আশঙ্কায় এসব বিষয়ে কেউ কথা বলতে চাইছেন না। পুলিশের কাছেও অভিযোগ করছেন না তারা। এদিকে নিজ দলের নেতাকর্মীর লুটের শিকার হওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। রামপাল উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মোতাহার হোসেন অভিযোগ করেন, ভোজপাতিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আল-আমিন শেখ শতাধিক লোক নিয়ে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তাঁর ২৪০ বিঘার চিংড়ি ঘের থেকে লাখ টাকার মাছ লুট করে নিয়ে গেছেন। এই ঘেরটি ভোজপাতিয়া ইউনিয়নের ক্যাটার্জীখালী গ্রামে। তিনি বলেন, ‘কী বলব বলেন– আমাদের দলের লোকই এই লুটপাট চালাচ্ছে।’ওই এলাকার আরেক বিএনপি নেতা বলেন, লুটপাট, দখল চলছে সব জাগয়ায়। যে যেমন পারছে করছে। কেউ কাউকে মানছে না। ১ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা চাওয়া হচ্ছে। চাঁদা না দিলে ঘের দখল করে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। এসব ঘটনা পুলিশকে জানাতেও ভয় পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বাগেরহাট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এটিএম আকরাম হোসেন তালিম বলেন, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ থাকায় আমরা ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছি। কোনো ধরনের অন্যায়কে আমরা সমর্থন বা প্রশ্রয় দেব না।