কুমারখালী (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি
কুষ্টিয়া কুমারখালী উপজেলার চড়াইকোল রেলস্টেশন। ঘাস লতাপাতা আর শেকড়বাকরে আষ্টেপৃষ্ঠে লাল ইটের দেয়াল ছেয়ে গেছে। ফুটো টিনের চালা, ভাঙা জানালা, যত্রতত্র ময়লার স্তূপ, জীর্ণশীর্ণ বোর্ডের সময়সূচিই যেন বলে দেয়, ‘সেদিন হয়েছে গত, যে দিন বাজত বাঁশি, পড়তো ঘণ্টা, যাত্রী ফিরে যেত নাকো’।
ব্রিটিশ আমলের ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহ্যবাহী চড়াইকোল এ স্টেশন। চড়াইকোল স্টেশনে কোনো ট্রেন থামে না। তাই বাজে না বাঁশি, পরে না ঘণ্টা, জ্বলে না পোস্টের বাতি। নেই স্টেশন মাস্টার তাই বিক্রিও হয় না কোনো টিকিট। সময়ের পরিক্রমায় জৌলুস আর যাত্রীদের ব্যস্ততা হারিয়ে পরিণত হয়েছে পরিত্যক্ত স্টেশনে।
চড়াইকোল স্টেশনে স্টেশন মাস্টারের জরাজীর্ণ কক্ষে ঠাঁই হয়েছে বিবর্ণ স্টেশনের মতই আকরাম হোসেন নামে উদ্বাস্তু এক ভিক্ষুকের। বাতিহীন ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে শেষ স্মৃতি হিসেবে থাকা মালশা মালার দেখভাল করার দায়িত্ব নিজেই পালন করছেন গত ৭-৮ বছর ধরে।অথচ ব্রিটিশ আমলে তৈরি এ স্টেশনে এক সময় ছিল ব্যস্ততা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে নামতেন এ চড়াইকোল স্টেশনে। তারপর ঘোড়ার গাড়ি চেপে যেতেন শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে। যাত্রীতে ঠাসা স্টেশনে রমরমা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। মুখরিত থাকত স্টেশন চত্বর।
সময়ের পরিক্রমায় প্রেক্ষাপট পাল্টে গেছে। এখন এখানে থামে না কোনো ট্রেন। এ ছাড়া অযত্নে নষ্ট হচ্ছে রেলের মূল্যবান যন্ত্রাংশ, চুরি হচ্ছে মালামাল। পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ ভবন পরিণত হয়েছে মাদকসেবীদের আড্ডাখানায়। এতে করে নষ্ট হচ্ছে সরকারের কোটি টাকার সম্পদ।দীর্ঘদিন ধরে স্টেশন মাস্টারের পরিত্যক্ত কক্ষে বসবাস করা ভিক্ষুক আকরাম হোসেন বলেন, মাস্টার রোলের চাকরি শেষে চলে যান স্টেশন মাস্টার। তখন থেকে সারাদিন ভিক্ষা শেষে রাতে এ কক্ষে থাকি। মাঝে মাঝে খালাসি এসে মালপত্র রেখে যায়। আমি সেগুলো পাহারা দিই।
চড়াইকোল স্টেশন বাজারের সাবেক সভাপতি মোতালেব হোসেন। ২৫ বছরের অধিক সময় ধরে স্টেশন সংলগ্ন বাজারটিতে ব্যবসা করছেন তিনি। তিনি বলেন, শিলাইদহের রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি, মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তবভিটা, বাউল সম্রাট লালন শাহের মাজারসহ বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থান স্টেশনটির কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে হওয়ায় স্থানীয়দের পাশাপাশি দর্শনার্থীদের কাছে এটি বেশ গুরুত্ব বহন করে।
তিনি বলেন, তা ছাড়া এ এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে স্টেশনটি রয়েছে আলাদা কদর। সাশ্রয়ী ভাড়া ও ঝঞ্ঝাটহীন দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকাতে ও শীর্ষে রয়েছে ট্রেন। এসকল দিক বিবেচনায় এনে দ্রুত স্টেশনটি সচল করার দাবি জানাই।
স্টেশনটি চালুর ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলে রাজবাড়ী ২ আসনের সংসদ সদস্য ও রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম কালবেলাকে বলেন, স্টেশন মাস্টার, লোক মাস্টার (ড্রাইভার), পয়েন্টস ম্যান, গার্ডসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোকবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে পর্যায়ক্রমে এ ধরনের সকল স্টেশন চালু করা হবে।
উল্লেখ্য, ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করে। এ লাইনকেই বর্ধিত করে ১৫ নভেম্বর ১৮৬২ সালে দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার ব্রডগেজ (১৬৭৬ মিমি) রেললাইন শাখা উন্মোচন করা হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১ জানুয়ারি ১৮৭১ সালে পদ্মা ও যমুনার সংযোগস্থলে অবস্থিত গোয়ালন্দঘাট পর্যন্ত ৭৫ কিলোমিটার রেললাইন উদ্বোধনের অংশ হিসেবে তৈরি করা হয় চড়াইকোল স্টেশনটি।