জাহিদ হাসান
সরকার সম্প্রতি কর কাঠামো সংস্কারে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে—জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে দুটি পৃথক ও স্বতন্ত্র বিভাগ গঠন করা হয়েছে। এটি শুধু কাঠামোগত পরিবর্তন নয়, বরং দেশের কর প্রশাসনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দক্ষতা আনার একটি সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু এই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এনবিআরের একাংশ কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়া উদ্বেগজনকভাবে আত্মরক্ষামূলক এবং প্রতিক্রিয়াশীল।দীর্ঘদিন ধরে এনবিআর একইসাথে কর নীতিনির্ধারণ এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে আসছে—যা আন্তর্জাতিকভাবে ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’ হিসেবে চিহ্নিত। কর আদায়কারী সংস্থাই যদি নীতি তৈরি করে, তবে সেখানে জবাবদিহির জায়গা থাকে না। অথচ এ ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে থাকা কিছু কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়, তারা যেন নিজেদের ‘ক্ষমতা হারানোর ভয়’ থেকেই এই সংস্কারের বিরোধিতা করছেন।এই ভয় কি অমূলক? আদৌ নয়।গত পাঁচ অর্থবছরে এনবিআর কখনোই রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪.৩৬ লাখ কোটি টাকা, কিন্তু তা থেমে গেছে মাত্র ৩.৪৫ লাখ কোটিতে—ঘাটতি প্রায় ৯১ হাজার কোটি টাকা। অথচ এই সময় জিডিপি ও বৈদেশিক বাণিজ্য উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে।শুধু তাই নয়, এনবিআরের নিজস্ব তদন্তেই উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। ২০২২ সালে শীর্ষ ৫০টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে—যা ‘ম্যানেজ’ করে করা হয়েছে, এবং কর্মকর্তাদের সহায়তা ছাড়া তা সম্ভব হতো না। কর ফাঁকি তদন্তের জন্য ঢাকার একটি অঞ্চলে ৮৭৫টি ফাইল চিহ্নিত করা হলেও, মাত্র ৭৫টি পর্যালোচনা করা হয়েছে। এসব তথ্যই বলছে, কর্মকর্তাদের একটি অংশের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির বলয় কতটা গভীর।এছাড়া, অনলাইন রিটার্ন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পথে কর্মকর্তাদের নিরুৎসাহ ও বাধা দেয়ার বিষয়টি কম উদ্বেগজনক নয়। কারণ এতে তাদের সরাসরি সুবিধা নেয়ার সুযোগ কমে যায়। ২০২৩ সালে ৮৫ লাখ টিআইএনধারীর মধ্যে মাত্র ৩৭ লাখ ব্যক্তি রিটার্ন দাখিল করেন—এটাও রাজস্ব প্রশাসনের প্রতি করদাতাদের আস্থাহীনতার একটি ইঙ্গিত।সরকার যখন এই পুরনো কাঠামোকে ভেঙে আধুনিক, নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন আলাদা করা মডেলে যেতে চায়, তখনই এনবিআরের কিছু কর্মকর্তা ‘চাকরি হারানো’, ‘ক্ষমতা হারানো’, কিংবা ‘অভিজ্ঞতা অপমানিত’ হওয়ার ভুয়া যুক্তিতে সংস্কারের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে চাইছেন। বাস্তবে এটি একদল সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর মুখোশ উন্মোচন ছাড়া আর কিছু নয়।দেশের কর ব্যবস্থাকে আধুনিক ও স্বচ্ছ করার এই প্রয়াসে সরকারকে নির্ভীক থাকতে হবে। শুধু কাঠামো নয়, এই পরিবর্তনের সফল বাস্তবায়ন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বার্থান্ধ কর্মকর্তা চক্রকে বিচ্ছিন্ন করাও সমান জরুরি।এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটি বার্তা—রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে বড় কেউ নয়। এনবিআরের সংস্কার তারই শুরু।