কণ্ঠ ডেস্ক
তারেক রহমান এখন রুলিং পজিশনে আছেন। স্ট্রং অবস্থান, অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রে তার অবস্থানই ‘টিকছে’। মানে তার পজিশনই সাসটেইন করছে। তারেক রহমান মানে বিএনপিও। বিএনপির পজিশন ঠিক আছে, কিন্তু এখনও নেগোশিয়েট করছে না।’ ‘বর্তমান ও আগামী দিনের রাজনীতিতে তারেক রহমানের সম্ভাব্য পজিশন ও প্রভাব যেন জাতীয় নেতৃত্বের দিকে ধাবিত হয়, সেই বিষয়ে বিএনপিকে আরও মনোযোগী হতে হবে’, এমন ভাষ্য বিএনপির সহমর্মী একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যানের। বুধবার (৫ মার্চ) রাতে আলাপকালে এই নেতা উল্লেখ করেন, বিশেষ করে ওয়ান-ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগ যেভাবে নেগোশিয়েট করেছে, এখন বিএনপি বা তারেক রহমান এটা শুরু করেছেন কিনা স্পষ্ট নয়। বিএনপির অভ্যন্তরেও দলটির সম্ভাব্য অবস্থান ও তারেক রহমানের জাতীয় নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। এরইমধ্যে বিগত বছরে তারেক রহমান তৃণমূলে ইফতার আয়োজনে বক্তব্য দিলেও এবার বিরত রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বিএনপি এখনও এসব বিষয়ে আলোচনা করেনি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিএনপি ও তারেক রহমানের হাতে। সেদিক থেকে যদি রাজনৈতিক বিবেচনায় ডেফিনেটলি তিনি অনেক দূর থেকে চেষ্টা করছেন, কিন্তু দলের অনুসারীরা অনেকেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তিনি যদি দল ঠিক রাখতে পারেন, নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, তাহলে দেশের পরিবর্তন হবে।’ তবে মান্না উল্লেখ করেন, নির্বাচন নিয়ে এখনও কোনও আলোচনা শুরু করেনি বিএনপি। গণতন্ত্র মঞ্চের একাধিক সিনিয়র নেতা মনে করেন, বিগত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বিএনপির পক্ষ থেকে যুগপতের দলগুলোর সঙ্গে সেভাবে কোনও আলোচনাই হয়নি। বিক্ষিপ্তভাবে মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে বিএনপির উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ হলেও সামগ্রিক কোনও আলোচনা করা হয়নি। এ বিষয়টি নিয়ে খোদ বিএনপিতেও আলোচনা হচ্ছে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে। গত কয়েক দিনে দলটির উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। একজন উচ্চ পর্যায়ের নেতা মনে করেন, বিএনপি মধ্যপন্থি নাকি ইসলামপন্থি অবস্থান নেবে, তা এখনও শীর্ষ নেতৃত্ব স্পষ্ট করেননি। দলের ভেতরে শীর্ষ পর্যায় থেকেই মেরুকরণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান একাধিক নেতা। স্থায়ী কমিটির একাধিক সূত্রের দাবি, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ কয়েকটি বিকল্প সামনে রেখে এগোচ্ছেন। দৃশ্যত ছাত্রদের নতুন দল নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য দিলেও ভেতরে-ভেতরে স্থায়ী কমিটি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক সদস্য নিবিড় যোগাযোগ রাখছেন। বিএনপির একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র মনে করছে, বিএনপি ছাত্রদের গঠিত দলের মধ্যে ভাঙন দেখতে চাইলেও অবিশ্বাস্য নয়। এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে আলাপ করলেও তারা স্বপরিচয়ে উদ্ধৃত হতে সম্মত হননি। কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনি পরিকল্পনায় বিএনপি ঠিক কোন পথে যাবে, তা এখনও স্পষ্ট না। এক্ষেত্রে জামায়াতের সঙ্গে আবারও ভিড়বে কিনা, এ প্রশ্নটিও থেকে যায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখনও অনেক সময় বাকি, তাই বিএনপি কোনও আলোচনা করেনি।’ রবিবার (৯ মার্চ) সন্ধ্যার পর এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে সময় লাগবে না। ঠিক সময়েই আমরা আলোচনায় বসবো।’ কবে নাগাদ হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিমা রহমানের জবাব, ‘সেটা তো বলতে পারছি না। রমজান যাক। চিন্তা-ভাবনা করছি কখন, কোত্থেকে প্রস্তুতি নেবো।’ এ বিষয়ে আমার বাংলাদেশ পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘বিএনপি সংস্কারের বিষয়ে আগ্রহী হলেও তাদের প্রধান ফোকাস হলো— তারা দ্রুত সংসদ নির্বাচন চায়। অপরদিকে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন সদ্য গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রধান চাওয়া ফ্যাসিবাদীদের বিচার ও সংস্কার, তারা এখনই নির্বাচনের বিপক্ষে।’ এবি পার্টির চেয়ারম্যান মনে করেন, দৃশ্যত দাবি নিয়ে দুই দলের ভিন্নমত মনে হলেও পর্দার আড়ালে উভয় দলের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে একটা সমঝোতার আলাপ আছে। দিন যত যাবে ধীরে ধীরে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের কাজের অগ্রগতি কী হবে বা কতটুকু হবে, সেটাও দেখার বিষয়। আমার ধারণা, বিএনপি চাপ এবং সমঝোতা দুই পথই খোলা রেখে এগোবে।’ বিএনপির একাধিক বিশ্লেষক মনে করছেন, বিএনপি এখনও মূল জায়গাটি ধরতে পারছে না। সমাজের প্রত্যেকটি পক্ষ এখন সক্রিয়। রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় মিশনারিগুলোও সক্রিয়। এই সক্রিয়তা একতরফা রূপ নিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ‘বিশেষ করে সরকারের আশীর্বাদ ও সুবিধাপুষ্ট যে রাজনৈতিক ধারাটি বিদ্যমান, তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী ভূমিকা সামনে আসার আগেই তারেক রহমানকে জাতীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে’- জোর দিয়ে বলেন দলটির উচ্চপর্যায়ে একজন দায়িত্বশীল। সব রাজনৈতিক দলের নেতারা তারেক রহমানের ভূমিকার ওপর নির্ভর করছেন এখনও— এমনটি মনে করেন বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল। তিনি উল্লেখ করেন, আগামী দিনে নির্বাচন, সরকার গঠন, সম্ভাব্য পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিগুলোকে প্রতিজ্ঞায় রূপান্তর করা, ৩১ দফাকে আরও বলিষ্ঠভাবে দৃশ্যমান করার মধ্য দিয়ে এই পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।’
‘সবাই ৩০০ আসনের গল্প ছড়িয়ে দিচ্ছে’
বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে বিভিন্ন পর্যায় থেকে তিনশ’ আসনে নির্বাচনের আলোচনা তোলা হচ্ছে। এটি একটি কৌশলের অংশ। মূলত তারেক রহমানের আসন বণ্টনের ওপর নির্ভর করছে নির্বাচনি রাজনৈতিক রূপ। বিশেষ করে তারেক রহমানের ভূমিকার দিকে আওয়ামী লীগের অবস্থান কবে নাগাদ প্রকাশ্য হবে, এও নির্ভর করছে। এ বিষয়ে দলের একজন দায়িত্বশীল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সবাই মনে করছে সব আসনে প্রার্থী দেবে। সবাই মনে করছে প্রার্থী দিলেই জিতবে। সবাই আলাদাভাবে নির্বাচন করলে বিএনপি ম্যাক্সিমাম বেনিফিটস পাবে। এক্ষেত্রে সরকার পরিকল্পিত নির্বাচন করলে আলাদা বিষয়। কিন্তু বিএনপি কি ভূমিধস বিজয় নিয়ে সরকার গঠন করবে, না অন্যান্য দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে সংসদীয় গণতন্ত্রকে আরও সংহত করবে, এ বিষয়টি নির্ভর করছে তারেক রহমানের ওপর।’ তিনি মনে করেন, ‘আসনভিত্তিক সমঝোতার কার্যক্রম শুরু করা দরকার। বাস্তবসম্মত উপায়ে অন্তত ৮০টি আসনের নিশ্চয়তা যুগপৎসঙ্গী ও নতুনদের মধ্যে বণ্টন করে দিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। একইসঙ্গে পরাশক্তিদের মধ্যে এখনও বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখার মতো বাস্তবতাও অনেকখানি কম। এদিক দিয়ে জনপ্রিয় দলের জনপ্রিয় নেতা হিসেবে তারেক রহমানের ওপরই নির্ভর করছে এই আসন বণ্টনের রাজনীতি।’ দলের প্রভাবশালী এই দায়িত্বশীল বলছেন, ‘অন্তত ৪০টি আসনে মুক্ত প্রার্থিতা করা যেতে পারে। তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হবে। একইসঙ্গে ভোটের মূল প্রোগ্রাম শুরু হবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের ফিরে আসার প্রক্রিয়ার ওপর। দলটি কোন পদ্ধতিতে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, তাও নির্ভর করছে বিএনপির আসন বণ্টনের কৌশলের ওপর।’ জানতে চাইলে খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে এখনও আসনভিত্তিক নির্বাচনি কোনও আলোচনা হয়নি। তবে তাদের সঙ্গে থাকা, তাদের ৩১ দফার ভিত্তিতে সর্বদলীয় সরকার গঠন নিয়ে আলাপ হচ্ছে। একেবারে সুনির্দিষ্ট করে নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। পাশাপাশি খেলাফত মজলিস দলীয়ভাবেও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি, ঠিক নির্বাচনের সময় কী করবে।’
৩০০ আসনের প্রস্তুতি জামায়াতেরও
তিনশ‘ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার আলোচনায় নাম এসেছে জামায়াতেরও। মঙ্গলবার (১১ মার্চ) বিকালে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘আমরা তো অনেক আগে থেকেই এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি। গণমাধ্যমে আলাপ করেছি। তিনশ’ আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি জামায়াতের আছে। আমাদের প্রার্থীও প্রস্তুত।’ তবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল উল্লেখ করেন, প্রশ্ন হলো—নির্বাচন নিকটে এলে রাজনীতিতে মেরুকরণ হবে। জোটবদ্ধভাবে ইসলামি দলগুলোর নির্বাচনের পরিবেশ হলে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রেখেছে। ‘ফলে যখনই কোনও জোট বা সমঝোতার প্রশ্ন আসবে, তখন নির্দিষ্ট আসন থেকে ছাড়াছাড়ি করতে হবে। বিভিন্ন দলের জন্য আমরাও আসন ছেড়ে দেবো’, বলেন সাবেক এই সংসদ সদস্য মিয়া গোলাম পরওয়ার।
তফসিলের আগে-পরে ফিরবেন দেশে
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় এলেই লন্ডন থেকে দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। এক্ষেত্রে তফসিল ঘোষণার আগে বা পরে তিনি আড়ম্বরে দেশে ফিরবেন। ফেরার পথে মা বেগম খালেদা জিয়াও সঙ্গে থাকতে পারেন। তবে, এ বিষয়টি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের নেতারা নীরব রয়েছেন। স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে আলাপেও তারা উদ্ধৃত হতে সম্মত হননি। যদিও সূত্র জানায়, এপ্রিলে খালেদা জিয়া দেশে ফিরবেন। তবে এ ধরনের তথ্যের কোনও সত্যতা মেলেনি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেশ কিছু দিন আগে তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে কথা বলেছিলেন। যদিও মঙ্গলবার এ বিষয়ে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলেও মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। গত ৪ মার্চ যুক্তরাজ্যে একটি ইফতার অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানান, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরবেন।