যৌথবাহিনীর অভিযান জোরদারের দাবি
যশোর অফিস
যশোরে বেপরোয়া চাঁদাবাজি, হত্যা, চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িত কিশোর গ্যাং। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্যমতে-যশোর বড়বাজার,শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন মহল্লায় ৪০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর অপরাধ দমনে যৌথবাহিনী দেশজুড়ে অভিযান চালাচ্ছে। যশোরে কিছু মাদক কারবারী, খুনি ও অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত কথিত ‘বড়ভাই’রা রয়েছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তারা আণ্ডারগ্রাউন্ডে থেকেও ‘অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করছে-এমন তথ্য মিলেছে গোয়েন্দা সূত্রে। ভুক্তভোগী মহলের অভিযোগ যৌথবাহিনীর অভিযান চলমান থাকলেও অপরাধীরা বহালতবিয়তে চাঁদাবাজি করছে। বড়বাজার থেকে শুরু করে শহরের এমন কোনো পাড়া-মহল্লা নেই, যেখানে কিশোর গ্যাং চাঁদাবাজি করছে না। এসব অপরাধীদের দলে নতুন নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। যারা পতিত সরকারের আমলে পলাতক ছিলেন তারাও প্রকাশ্যে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে ভুক্তভোগী মহল থেকে অভিযোগ আসছে। তাদের অভিযোগ থানায় অভিযোগ দেয়া হচ্ছে কিন্তু দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না পুলিশের। রাজনীতি সচেতন মহল আক্ষেপ, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অপরাধ নির্মূলের আভাস পাচ্ছিলাম। যৌথবাহিনী অভিযানও পরিচালনা করছে কিন্তু অপরাধ নির্মূলের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দেদারছে চাঁদাবাজি হচ্ছে। বিকাশে চাঁদা নেয়ার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। কিশোর গ্যাং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা শহরে। যেকারণে ভয়ে মানুষ টু-শব্দ করতে পারছে না। বিভিন্ন মহল ও গোয়েন্দা সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে- মাদক-অস্ত্র কারবারী, চাঁদাবাজি ও খুন-খারাপির নেতৃত্ব দিচ্ছে বহুল আলোচিত ‘গডফাদার’রা চক্র। তারা ভারতে পালিয়েছে ‘প্রচার দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা তাদের আশ্রয়-প্রশয়দাতা কথিত বড়ভাইদের নির্দেশে বড়বাজারসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় চাঁদাবাজি, খুন-খারাপি, হত্যা ও হত্যার হুমকি দেয়াসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অপরাধে জড়িতদের পাল্লা আরও ভারী হয়েছে। আত্মগোপনে থাকা চিহিৃত চাঁদাবাজরা অপরাধীদের ডেরা থেকে বেরিয়ে এসে যোগ দিয়েছেন অপরাধ জগতে। যেকারণে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, কুপিয়ে জখম এমনকি খুন-খারাপিতেও মদদ দিচ্ছে। এরমধ্যে ভুক্তভোগীদের অনেকে থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। তবে থানা পুলিশ এসব নিয়ে নিরব ভুমিকায় রয়েছে। ডিবি পুলিশের কিছু তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। যৌথবাহিনীর অভিযানে এখন পর্যন্ত ‘গডফাদারদের কেউ গ্রেফতার হয়নি। এরমধ্যে যশোর শহরতলী খড়কি-খোলাডাঙ্গায় অন্তত ৩ জনকে খুন করা হয়েছে। এসব হত্যায় জড়িত কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। ক্লুলেস মামলার আসামিদের গ্রেফতারে কাজ করছে পিবিআই। র্যাব আগের মতো বড় ধরনের সাফল্য দেখাতে পারছে না-এমন অভিযোগ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার ভুক্তভোগীদের। তাদের অভিযোগ-কথিত বড়ভাইরা আত্মগোপনে থাকলেও তাদের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা আগের মতোই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। ভুক্তভোগীরা যৌথবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তাদের ভয় কোনো রকম নাম ফাঁস হলে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বেঁচে ফেরা যাবে না। র্যাব-পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে-মাদক, দারিদ্র,পারিবারিক সংকট, রাজনৈতিক আশ্রয়,প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে।থানা পুলিশের তথ্যানুযায়ী,যশোর বড়বাজার,শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন মহল্লায় অন্তত ৪০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। একেকটি গ্রুপে অন্তত ৮ থেকে ১৬ জন করে সদস্য রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো এলাকায় একই সঙ্গে ৩/৪টি গ্রুপও তৎপরতা চালাচ্ছে। আর এসব গ্রুপের সঙ্গে জড়িতদের বয়স ১৪ থেকে ২১ বছর বয়সের মধ্যে। সরকার পরিবর্তনের পর অপরাধীদের পাল্লা আরও ভারী হয়েছে। তবে সবাই নজরদারীর ভেতর রয়েছে। র্যাব ও পুলিশ জানায়, বিভিন্ন অপরাধে জড়িত কিশোররা দেশি অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা এমনকি অপহরণ, বোমাবাজি ও হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর অপরাধেও জড়িত তারা। বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা চাকু, ছুরি, রামদার মতো দেশি অস্ত্র ছাড়াও বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী-যশোর শহরের বড়বাজার, রেলবাজার, বেজপাড়া, শংকরপুর, বকচর, খড়কি-খোলাডাঙ্গা, চাঁচড়া, রেলগেট, তুলোতলা, ভাতুড়িয়া, শংকরপুর বাস টার্মিনাল, রেল রোড, মুজিব সড়ক, ষষ্টিতলাড়া, মুজিব সড়ক বাইলেন, মণিহার, উপশহর, পালবাড়ি, ধর্মতলা, রেল স্টেশন, বিরামপুর, নীলগঞ্জ, সিটি কলেজপাড়া, বারান্দিপাড়া, খড়কি কলাবাগান, পুলেরহাট, বিরামপুর, হামিদপুর, তেঁতুলতলা ও শেখহাটিতে গ্রুপ ভিত্তিক কিশোর অপরাধীর তৎপরতার অভিযোগ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এরবাইরে শহরতলীর ঝুমঝুমপুর ,হামিদপুর, ঝাউদিয়া, চুড়ামনকাটি, হাসিমপুর, সুজলপুর ভেকুটিয়া, ইছালী, কিসমত নওয়াপাড়া, এনায়েতপুরে আরও কয়েকটি গ্রুপ দেশি অস্ত্র চাকু নিয়ে সরব হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব এলাকাসহ অর্ধশত স্থানে কিশোররা গ্রুপ তৈরি করেছে। সন্ত্রাসী চক্রের উঠতি সদস্যদের সাথে যুক্ত হচ্ছে এসব কিশোররা। এরা কখনো বিচ্ছিন্নভাবে আবার কখনো অন্যের হয়ে টাকার বিনিমিয়ে নানা অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। পতিত সরকারের শাসনামলে যারা আত্মগোপনে ছিলেন, তারাও প্রকাশ্যে এসে অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশ বলছে, গত বছর ও চলতি বছরে যশোর টিবি ক্লিনিক পাড়ার সোলাইমান,সুজলপুরের ইরিয়ান, শংকরপুরের আফজাল হোসেন, কলেজছাত্র সুলতানপুরের আব্দুল্লাহ, শংকরপুরের টুনি শাওন, উপশহরের এহসানুল হক ইমু, শংকরপুরে বিএনপি নেতা বদিউজ্জামান ধনি, খালধার রোডের পন্ডিত পুকুরপাড়ের হাবিবুর রহমান হবির ছেলে অনুরাগ ইসলাম অপু ওরফে আশিকুর ইসলাম অপু, শংকরপুরে আশ্রম রোডের ধনাঢ্য রোশনি বেগম হত্যাকাণ্ড এবং চাঁচড়া বর্মণপাড়া শ্মশান ঘেঁষা খালে ফেলে রনি হত্যাকাণ্ডের মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনার সঙ্গে কিশোর গ্যাং জড়িত। সর্বশেষ খড়কি খোলাডাঙ্গায় আসাদুল ও সজলসহ ৩ জন খুন হয়েছে। এরমধ্যে কয়েকজনকে আটক করা সম্ভব হয়েছে। বেজপাড়া সাদেক দারোগার মোড়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আসাদ,খড়কি ধোপাপাড়ার ইরফান ফরাজী, বারান্দিপাড়ার কিশোর নাহিদ ও ঘুরুলিয়ার ইউনুছ হত্যাকাণ্ডেও কিশোর গ্যাংয়ের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ভেতরেই ৩ বন্দি কিশোরকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা খোদ প্রতিষ্ঠানের বন্দিরা। সেখানেও বন্দি ৮ কিশোরের একটি গ্রুপ গড়ে ওঠার তথ্য রয়েছে। যশোর থানা ও জেলা পুলিশের মিডিয়া সেল ও র্যাব জানায়,এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ছাড়াও যশোর শহর ও শহরতলীর অর্ধশত স্পটে অভিযান চালিয়ে কিশোর সন্ত্রাসীদের আটক করেছে ডিবি ও পিবিআই। বকচরের চাঞ্চল্যকর রাকিব সরদার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বকচর,শংকরপুর,সিটি কলেজ পাড়াসহ আরও কয়েকটি এলাকার কিশোর গ্যাঙের ৯ সদস্যকে আটক করে র্যাব-৬। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন,মাদক,দারিদ্রতা, পারিবারিক সংকট, সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক আশ্রয়ের মতো ঘটনাগুলো কিশোর অপরাধের পেছনে কাজ করছে।পিবিআই যশোর ইউনিটের একাধিক সূ্ত্রমতে-এলাকায় কার ক্ষমতা কত বেশি,কে কার সিনিয়র,কে জুনিয়র এ নিয়ে কিশোরদের মধ্যে হরহামেশাই হচ্ছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। হাতাহাতি ও খুন-জখমের ঘটনাও ঘটছে। কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে কথিত বড়ভাইরা অনেকাংশে দায়ি। তারা কিশোর পরিবারগুলো দরিদ্রতা, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যাকে কাজে লাগিয়ে আধিপত্য বিস্তার করেছেন। এখনো তারা আত্মগোপনে থেকে তাদের মাদক-অস্ত্র বেচাবিক্রির কারবার পরিচালনার পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও খুন-জখমের নির্দেশ দিচ্ছে বলে বিভিন্ন মহল সূত্রে খবর আসছে। যশোরের প্রেক্ষাপটে কিশোররা কেন নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এবং এর প্রতিকার কী এসব নিয়ে কথা হয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার সাথে। তিনি জানান, যশোরের প্রেক্ষাপটে মরণ নেশা মাদক, স্থানীয় উঠতি রাজনীতিকদের আশ্রয়, মাদক ব্যবসায়ীদের ইন্ধন, সামাজিক পারিবারিক শাসন অনেকটা কমে আসার কারণে কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এই কর্মকর্তা মনে করেন, সচেতনতার এই কাজে র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি সামাজিকভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং তৃণমূল পর্যায়ে কাউন্সিলিং বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।ভুক্তভোগী মহলের দাবি-কথিত বড়ভাইরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকলেও তাদের আশ্রয়-প্রশয়ে এখনো কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে খুন-জখম করছে। যৌথবাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে কিন্তু কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকা ছাড়েনি। তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার সাহস অনেকেরই নেই। একারণে সাড়াশী অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধার করা জরুরী। অন্যত্থায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সুফল মানুষ পাবে না।এক্ষেত্রে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা বাজার থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লায় অপরাধ নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাদেরও এগিয়ে আসার দাবি ভুক্তভোগী মহলের।