জাহিদ হাসান
বেনাপোল বন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রেজাউল করিমের মদদে স্থলবন্দরে সীমাহীন দুর্নীতির আখড়ায় পরিনত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বন্দর ব্যবহারকারী সংগঠনগুলো। দুর্নীতির বরপুত্র খ্যাত রেজাউল করিম যে বন্দরেই দায়িত্ব পান সেখানেই গড়ে তোলেন দুর্নীতির রাম-রাজত্ব। তার বিরুদ্ধে দুদক সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে একাধিক অভিযোগ চলমান থাকলেও অদৃশ্য শক্তিতে স্থল বন্দরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমান বেনাপোল স্থলবন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েই পেছন থেকে চালাচ্ছেন চাঁদাবাজির স্ট্রিম রোলার। বেনাপোল স্থলবন্দরে আমদানি পণ্যবাহী ট্রাক থেকে লোড আনলোড সহ বন্দর নির্ধারিত ফি ছাড়াও অতিরিক্ত মাশয়ারা ১ হাজার থেকে ১৫শ টাকা (চাঁদাবাজি) আদায় বন্ধে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করেছেন বন্দর ব্যবহারকারী একাধিক সংগঠন।গত সোমবার (২৪ জুন) বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতি ও যশোর জেলা ট্রাক এবং ট্যাংকলরি ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বিভিন্ন দপ্তরে বন্দরে ঘটিত চাঁদাবাজি বন্ধে এ আবেদন জানানো হয়। অভিযোগে বলা হয়েছে, বেনাপোল বন্দরে আমদানি, রফতানি পণ্য ওঠানো, নামানোর কাজে নিয়োজিত ৯২৫ ও ৮৯১ দুই শ্রমিক ইউনিয়নে প্রায় ২ হাজার শ্রমিক রয়েছেন। শ্রমিক সংগঠন দুটি বেসরকারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের হয়ে বন্দরে পণ্য খালাসের কাজ করেন। বর্তমান বন্দরে পণ্য গাড়িতে ওঠানো ও নামানোর পর শ্রমিকদের বকশিস (চাঁদাবাজি) যেটা আগে ৩ থেকে ৫শ টাকার মধ্যে ছিল এখন সেটা বেড়ে ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়েছে। অথচ এই সিমাহীন দুর্নীতির বিষয়ে স্থলবন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালককে একাধিকবার বলা সত্বেও কোন মাথাব্যাথা নেই।দৈনিক বেনাপোল বন্দর থেকে গড়ে ৬শ ট্রাক বিভিন্ন ধরনের পণ্য খালাস হয়। ট্রাকপ্রতি যদি ১ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয় তাহলে দিনে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ লাখ টাকা। সরকারি ছুটির দিন বাদ দিলে মাসে ২০ দিন ধরলে দাঁড়ায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। ১ বছরে আনুমানিক ২৪ কোটি টাকা। বেনাপোল বন্দরে পণ্য লোড় করতে আসা ট্রাক ঢাকা মেট্রো-ট ১২-১৩৬৪ চালক সাইফুল জানান, গাড়ী লোড়ের পর শ্রমিকদের বকশিস আগে ৩শ টাকা দিতাম আজ ১৫শ টাকা নিয়েছে। ঢাকা মেট্রো ট-২৪-৭৩৩৪ চালক আমিনুর জানান, গাড়ী লোডের পর শ্রমিকদের ৫শ টাকা দিলে তারা বলে ১২শ টাকা দিতে হবে তা না হলে গাড়ী ছাড়া হবে না। বাধ্য হয়েই টাকা দিয়েছি।বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজিম উদ্দীন গাজী বলেন, বেনাপোল বন্দরে শ্রমিকেরা যে সকল পণ্য খালাস করেন,তার মজুরি ব্যবসায়ীরা রিসিটের মাধ্যমে পরিশোধ করেন। কিন্তু ট্রাক লোড ও আনলোডের পর বর্তমান বন্দরের শ্রমিকরা জোর পূর্বক ট্রাক প্রতি অতিরিক্ত ১৫শত থেকে ২হাজার টাকা আদায় করছে। কোন কিছু বললে ট্রাক চালকদের সাথে বিভিন্ন হয়রানি সহ ট্রাক আটকের ঘটনাও ঘটছে। এহেন চাঁদাবাজি বন্ধের বিষয়ে বন্দরের পরিচালককে জানানো হলেও তিনি কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। প্রতিকার না পেয়ে অবশেষে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ ১১ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চাঁদাবাজির প্রতিরোধ চেয়ে চিঠি দিয়েছি।এ বিষয়ে বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান বলেন, বর্তমানে পণ্য খালাসে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ সময় লাগছে এবং তাছাড়া শ্রমিকদের বকশিস (চাঁদাবাজি) যেটা আগে ৩শত টাকা থেকে ৫শত টাকার মধ্যে ছিল। এখন সেটা বেড়ে দেড় ২ হাজার টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে বন্দরে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তাছাড়া বেশ কয়েক বছর ধরে বেনাপোল বন্দরে নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। বন্দরে জায়গার অভাবে দিনের পর দিন পণ্য নিয়ে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকায় লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। যার প্রভাব পড়ছে দেশীয় বাজারে আমদানি পণ্যের ওপর। অথচ এ বন্দর থেকে প্রতিবছর সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছে।বেনাপোলের একাধিক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসায়ী জানান, বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশের ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ীর বাণিজ্যের চাহিদা থাকলেও যথাযথ উন্নয়ন নেই বন্দর কর্তৃপক্ষের। দ্রুত পণ্য খালাসে নতুন শেড, ইয়ার্ড, ক্রেন, ফর্কক্লিপ যুক্ত করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীদের গুরুত্ব বুঝে বন্দর আধুনিকায়ন করা জরুরী। দেশের চট্রগ্রাম,মোংলা স্থলবন্দরে লোড এবং আনলোডে সিরিয়াল দিলেই পণ্য খালাশ হয়ে যায়। অথচ বেনাপোলে রিসিটের মাধ্যমে সকল টাকা পরিশোধ করলেও অতিরিক্ত অর্থছাড়া কোন গাড়ী লোড বা আনলোড হয়না। এ বিষয়ে পোর্ট কর্তৃপক্ষকে জানালেও তাদের কোন মাথাব্যাথা নেই।ভারতীয় বিধান সভার সদস্য শ্রী অশোক কীর্তানিয়া গত ১০ই জুন তার ইস্যুকৃত চিঠিতে জানান, বেনাপোল বন্দরের পণ্য খালাসসহ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার স্থায়ী সমাধান চেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন তিনি। চিঠিতে তিনি লিখেছেন বন্দরে আনলোড থেকে শুরু করে লরি ভারতে ঢোকা পর্যন্ত বেনাপোল স্থলবন্দরের ১৪টি পয়েন্টে অতিরিক্ত টাকা আদায়,গাড়ী প্রবেশের পর দীর্ঘদিন সময় ক্ষেপন, ট্রাক হতে ব্যাটারী ও পণ্য চুরি, জায়গা সংকট বন্দর কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানিয়েও কোন সমাধান পাননি। মুঠোফোনে তিনি আরো জানান, ভারত হতে যখন বেনাপোল বন্দরে লরি প্রবেশ করবে সে লরির সম্পূর্ন দ্বায়িত্ব পড়ে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কিন্ত বাংলাদেশে সম্পূর্ন ভিন্ন। বন্দরে লরিতে থাকা পণ্য ও চালকের সাথে বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও অভিযোগ দিলে তার কোন সূরহা মেলেনা।এ বিষয়ে বেনাপোল বন্দর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, বন্দরে সক্ষমতা বাড়াতে বিভিন্ন উন্নয়ণ মুলক কাজ চলছে আর শ্রমিক চাঁদাবাজির বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। কোনো ধরনের চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।