কণ্ঠ ডেস্ক
পাওনা টাকা আদায় করা নিয়ে দ্বন্দ্বে গলাটিপে হত্যার পরে যশোরের ব্যবসায়ী রেজাউল ইসলামের লাশ সাতক্ষীরার আশাশুনির একটি বাগানে মাটিতে পুতে রাখা হয়। সোমবার আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিতে আসামি রবিউল ইসলাম সবুজ এসব তথ্য জানিয়েছেন। একইদিন শ্বশুরও আদালতে জবানবন্দি দেন। এদিকে, রবিউলের শ্বশুরের পর তার স্ত্রী প্রিয়াংকাকেও আটক করেছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। সোমবার আটক সবুজ, রিপন, শ্বশুর খোকন মোল্লা ও স্ত্রী প্রিয়াংকাকে আদালতে সোপর্দ করা হলে বিচারক যশোরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রহমত আলী আটক চারজনকে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেন।অন্যদিকে, রোজাউলের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার আসরবাদ শংকরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে নামাজের জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন করা হয়। এসময় স্থানীয় এলাকাবাসী জড়িতদের দ্রুত বিচারের দাবি জানান।আসামি সবুজ জানিয়েছেন, তিনি শংকরপুর গোলপাতা মসজিদ এলাকার কামরুল ইসলামের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করেন এবং ব্যবসা করেন। নিহত রেজাউল ইসলামও একই বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করেন। একই বাড়িতে বসবাস এবং চলাফেরার কারণে দু’জনের মধ্যে খুব ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে রেজাউল ইসলাম মাঝেমধ্যে সবুজের কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন। ঘটনার আগে ২১ এপ্রিল সবুজের ব্যবসা সংক্রান্তে টাকার প্রয়োজন হয়। ২২ এপ্রিল গভীর রাত সাড়ে ১২টার দিকে রেজাউল ইসলামকে মোবাইল করে ঘর থেকে বের আনা হয়। ঘরের বাইরে রেজাউলের কাছে পাওনা টাকা দাবি করেন সবুজ। কিন্তু রেজাউল টাকা দিতে পারবেনা বলে সবুজকে জানান। এতে দু’জনের মধ্যে তর্কবিতর্কের এক পর্যায় রেজাউলের গলা টিপে ধরেন সুবজ। কিছুক্ষণ রাখার পরে নিস্তেজ হয়ে পড়েন রেজাউল। মোবাইলের লাইট জালিয়ে দেখেন রেজাউল মারা গেছেন। সাথে সাথে তার লাশ সবুজের ঘরের মধ্যে নিয়ে রাখেন। বিষয়টি সবুজ তার স্ত্রী প্রিয়ঙ্কাকে জানান। প্রিয়ঙ্কা রাগারাগি করলেও শেষ পর্যন্ত লাশটি লুকানোর জন্য বলেন তার স্বামীকে। এরপরে পলিথিন, কাপড় ও ডোপ (কাটুন) কিনে এনে রাতেই তার পরিচিত একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে সবুজ তার শ্বশুর খোকন মোল্যার বাড়ির পাশে বাগানে নিয়ে মাটিতে পুতে রাখেন। লাশটি পুতে রাখার জন্য কোঁদাল আনতে গেলে তার কাছে শ্বশুর বাড়ির এতরাতে কি করবে জানতে চায়। তবে সবুজ সে সময় বলেন কলা গাছ রোপন করবেন। রাতেই আবার সবুজ যশোরে ফিরে আসেন। পরদিন সকালে সবুজের শ্বশুর বাগানে গিয়ে নতুন মাটি কাটা দেখে সন্দেহ হয়। ফলে তিনি আবার কোঁদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে লাশটি দেখতে পান। কিন্তু লাশ দেখে ভয়ে নিজের বাগান থেকে পাশে একটি মাছের ঘেরের কাঁদা মাটিতে পুতে রাখেন।অন্যদিকে, রাতে বাসা থেকে বের আর না ফেরায় বিভিন্নস্থানে খোঁজখবর নিয়ে স্বামীর কোন সন্ধান না পেয়ে ২৬ মার্চ কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন রেজাউলের স্ত্রী মমতাজ বেগম।অপর একটি সূত্র জানায়, সাধারণ ডায়েরি করার পরই পুলিশ বিষয়টি নিয়ে মাঠে নামেন। এক পর্যায় সবুজ ও রিপনকেকে সন্দেহ হয়। পরে তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞাবাদের পর ছেড়ে দেয়। এরপর থেকেই সবুজ লাপাত্তা হয়ে যায়। এক পর্যায় সবুজ মোবাইলের থেকে নিজের সীম খুলে চট্টগামে যেয়ে হরি নামের একজনের সীম ব্যবহার শুরু করে। পুলিশ ওই হরির মাধ্যমে আটক করে সবুজকে। এই ঘটনায় রেজাউলের স্ত্রী বাদী হয়ে ২৬ এপ্রিল সবুজ ও রিপনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। রাতভর জিজ্ঞাসাবাদের পর আটক সবুজ পুলিশের কাছে এই হত্যাকা-ে জড়িত বলে স্বীকার করেন। ২৭ এপ্রিল সাতক্ষীরার আশাশুনি থেকে রেজাউলের লাশ কাঁদা মাটিতে পুতে রাখা অবস্থায় উদ্ধার করে। সেখান থেকেই পুলিশ আটক করে সবুজের শ্বশুর খোকন মোল্যা ও তার স্ত্রী প্রিয়ঙ্কাকে। এরআগে যশোরে থানায় ডেকে এনে পুলিশ আটক করে রিপনকে। গতকাল সোমবার চারজনকেই আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। এরমধ্যে সবুজ ও তার শ্বশুর খোকন মোল্যা হত্যা এবং লাশ গুমের কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। পাশাপাশি অপর আটক সবুজের স্ত্রী প্রিয়ঙ্কা এবং রিপনকেও জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দেন বিচারক।অপরদিকে এই হত্যাকা-ে রিপন আহম্মেদ জড়িত নয় বলে গতকাল সোমবার প্রেসক্লাব যশোরে সংবাদ সম্মেলন করেছেন রিপনের স্ত্রী শাহনাজ পারভীন আসমা। তিনি বলেছেন তার স্বামীকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এবং ষড়যন্ত্র করে রেজাউল হত্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। তিনি তার স্বামীকে মুক্তির দাবি করেন।এদিকে, সোমবার শংকরপুর এলাকায় বিক্ষুব্ধ জনতা সবুজ ও রিপনের দ্রুত বিচারের দাবিতে ফুসরে উঠে স্থানীয়রা। তারা সবুজ ও রিপনকে নিয়ে নানা অভিযোগ করতে থাকেন। তারা জানান, সবুজ ছিলেন বনদস্যু। শ্যামনগরে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে। এক পর্যায় প্রশাসনের ভয়তে তিনি যশোরে এসে আশ্রয় নেন। প্রথমে তিনি নির্মান শ্রমিক ছিলেন। পরবর্তীতে স্থানীয় এক প্রভাবশালীর আশ্রয়ে দোকান দারি শুরু করেন।তারা আরও জানান, অপর আসামি রিপন ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। তার বাবা ছিলেন বাদশা পকেটমার। এছাড়া মা ও খালা ছিলেন মারোয়ারি মন্দিরের ঘর মালিক। ও নানা ছিলো রওনক চেম্বার এলাকার মদ ব্যবসায়ী। রিপন এলাকার চিহ্নিত চোরাকারবারী। বেনাপোলে থেকে তিনি ভারত থেকে বিভিন্ন অবৈধ পন্য এনে যশোরসহ সারা দেশে সবরাহ করেন। আর তার অন্যতম সহযোগি সবুজ নিজেই। স্থানীয়রা সবুজ ও রিপনের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দাবি করেছেন।কোতয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ আবুল হাসনাত খান জানান, সবুজ অত্যন্ত ধূরন্ধর প্রকৃতির। ঘটনার পরপরই তাকে থানায় ডাকা হয়েছিলো। কিন্তু তিনি অস্বীকার করেন। এক পর্যায় তিনি আত্মগোপনে চলে যান। তিনি আরও জানান, পুলিশের একাধিক টিম এ ঘটনা নিয়ে কাজ করে। এমনকি পুলিশ সুপার নিজেও বিষয়টির তদারকি করেন। একপর্যায় তারা নিশ্চিত হয়েই সবুজকে ধরতে অভিযানে নামেন। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। তিনি বলেন, আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন সবুজ। টাকা পয়সার জেরেই খুন করা হয়েছে বলে তিনি নিশ্চত করেন।