নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের চাহিদার সিংহভাগ সবজি সরবরাহ করে যশোরের চাষিরা। তবে টানা বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবজির ক্ষেত ও বীজতলা। কয়েক দফায় সবজির চারা রোপণ করেও বাঁচানো যায়নি। দেরিতে রোপণ করায় শীতের আগাম মৌসুমী সবজি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়াতে প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারগুলোতে। ফলে সব ধরনের সবজির দাম বেশ ঊর্ধ্বমুখী। চাষিরা বলছেন, বেশ কয়েকবার টানা বৃষ্টির কারণে সবজির ক্ষেত নষ্ট হওয়ায় উৎপাদন কমেছে। এতে খরচ ওঠাতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী বাজারে দ্রæতই সবজি সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে ক্রেতাদের নাগালের থাকবে সবজির দাম। সদরের চুড়ামনকাটি, বারিনগর হৈবতপুর এলাকার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে বিস্তৃর্ণ মাঠ জুড়ে সবজি থাকার কথা সেখানে মাঠে সবজি কম। মাঠ জুড়ে সবজি চাষ হলেও সেগুলোতে ফলন নেই। কিছু কিছু ক্ষেতে সবজি দেখা গেলেও সেগুলো পর্যপ্ত না। আবার কিছু কিছু জায়গায় সবজি চাষ করার জন্য ক্ষেত প্রস্তুত করতেও দেখা গেছে। হৈবতপুর গ্রামের কৃষক আলতাপ হোসেন বলেন, ‘যে সময়ে জমিতে সবজির থাকার কথা, সেই সময়ে সবজির চাষ শুরু করছি। এতোদিন বৃষ্টির কারণে আবাদ করতে পারেনি। দুই মাস ধরে জমি ফেলানো। জমিতে চাষ দিলেই বৃষ্টিতে জমির জো (মাটির উর্বরতা) নষ্ট করে দেয়। পাশেই জুম্মন আলীর জমি। তিনি বলেন, দেড় বিঘা জমিতে মুলা লাগিয়েছি, প্রথমবার বীজ রোপণের সপ্তাহখানিক পর হাঁটু পানি জমে। এতে প্রথমবার সব মার। দ্বিতীয়বার লাগালাম, সেইবারও বৃষ্টি। পরে লাগানোর পর চারা বেঁচে। সেই মুলা অল্প অল্প করে বাজারে বিক্রি করছি। আমার মতো মাঠে সবজি নষ্ট হওয়াতে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সবজি তুলতে পারছি না।’ দেশের অন্যতম বৃহৎ সবজি বাজার যশোরের সাতমাইল-বারীনগর। যশোর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে এই সবজি হাট। বর্তমানে প্রতিদিন বসে হাটটি। তবে রোববার ও বৃহস্পতিবার চাঙা। গত শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, ছয় থেকে সাতটি ট্রাকে সবজি ওঠানোর কাজে ব্যস্ত ব্যাপারী ও শ্রমিকেরা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অন্য বছরের এই সময় হাটের দিনে ৩০ থেকে ৩৫টি ট্রাকে সবজি ওঠানো হতো। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলা শহরে এই সবজি পাঠানো হতো। এ বছর সেখানে সবজির সরবরাহ কমে গেছে। আলমগীর হোসেন নামে এক কৃষক বলেন, ‘এবার দুই বিঘা জমিতে বেগুন, দেড় বিঘা জমিতে মুলা আর আধা কাটা জমিতে মরিচ চাষ করেছি। অত্যধিক বৃষ্টির কারণে চার দফা এই সবজির গাছগুলো রোপন করা লেগেছে। বারবার সবজির চারা রোপন করাতে সবজির গাছ বড় হতে দেরি হয়েছে। এই সময়ে বাজারে ভরপুর সবজি থাকার কথা থাকলেও উৎপাদন কম হওয়াতে বাজারে সবজি নেই। চাহিদার মতো সবজি উৎপাদন না হওয়াতে বাজারে সবজির দাম বেশি।’ বাজারের ব্যাপারী মতিয়ার হোসেন বলেন, এক মাস ধরে বাজারে সবজির সরবরাহ কম। বছরের এ সময় প্রতি হাট থেকে ৫০-৬০ ট্রাক সবজি দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো। আর এখন যাচ্ছে ১০ থেকে ১২ ট্রাক সবজি। বাজারে সরবরাহ কম থাকায় দামও চড়া। কৃষক সোলাইমান মুন্সী বলেন, প্রতিটি সবজি চাষে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ খরচ বেড়েছে। ফসল মারা যাওয়ার সঙ্গে গত বছরের তুলনায় এ বছর সার, কীটনাশক, সেচ ও শ্রমিকের খরচ বেড়েছে। আবহাওয়ার কারণে ফসলের উৎপাদন কম হয়েছে। ফলে বাজারে যতটুকু সবজি উঠছে, তার দাম চড়া হয়ে যাচ্ছে।’ কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, এ বছর অসময়ে অতিবৃষ্টিতে শীতকালীন আগাম সবজির উৎপাদন ২৫ শতাংশ কমে গেছে। শুক্রবারও যশোরে ১৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাতে বাজারে সবজির দাম বাড়তি। তবে কৃষকেরা আগাম সবজির চাষ শুরু করেছেন। দ্রæতই সরবরাহ বাড়বে বলে আশা করা যায়। গত শনিবার সাতমাইল পাইকারিতে কৃষকেরা প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ (দেশি) বিক্রি করেন ৪২০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এই দাম ছিল ৩৯০ টাকা। একইভাবে করলার দাম কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ৮০ টাকা, বেগুনের দাম ৮০-৯০ টাকা, কাঁকরোল ৭০- ৭৫, পেপের দাম কমে ২০-২৫ টাকা, শসা ৫৫ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৬০ টাকা, মুলা ৫০, শিম ১১৫ টাকা। এই বাজারের চট্টগামের পাইকারের এজেন্ট আনোয়ার হোসেন বলেন, যশোরে প্রতিনিয়ত বৃষ্টি হচ্ছে। এতে সবজিরি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। হাটে এখন সবজির সরবরাহ কম। অন্যান্য বছর এ সময় শীতকালীন আগাম সবজিতে প্রচুর সরবরাহ থাকত। এ কারণে দাম চড়া। পাইকারদের তথ্যমতে, যশোরের মোকাম থেকে এক কেজি সবজি ঢাকার কারওয়ান বাজারে নিতে পরিবহন খরচ পড়ে ২ টাকা ৩৫ পয়সা। তার সঙ্গে শ্রমিক, মোড়কজাত বাবদ খরচ যোগ হয় কেজিতে আরও এক থেকে দুই টাকা। অর্থাৎ এক কেজি সবজি যশোর থেকে কারওয়ান বাজারে আসতে খরচ পড়ে প্রায় সাড়ে চার টাকা। যশোর আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, যশোর জেলায় জুলাই থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ২৭৫১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা গত বছর ছিলো ১৫ শ’ ৭০ মিলিমিটার।